ঈশ্বর গুপ্ত থেকে আরম্ভ করে রামগতি ন্যায়রত্ন, রমেশচন্দ্র দত্ত, দীনেশচন্দ্র সেন, সুশীলকুমার দে, সুকুম...
ঈশ্বর গুপ্ত থেকে আরম্ভ করে রামগতি ন্যায়রত্ন, রমেশচন্দ্র দত্ত, দীনেশচন্দ্র সেন, সুশীলকুমার দে, সুকুমার সেন প্রভৃতি পণ্ডিত ও গবেষকেরা প্রাচীন ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের যে-সমস্ত ইতিহাস লিখেছেন তার সম্বন্ধে শিক্ষিত ব্যক্তিরা অবহিত আছেন। বিদেশীরাও বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক বিবর্তনের প্রতি, কৌতূহল বোধ করে থাকেন। চেকভাষী গবেষক ও পণ্ডিত ডুসান জ্বাভিটেল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস চর্চা করে বাঙালিমানসিকতার অন্তরঙ্গতা লাভ করেছেন। ইংরেজিতে লেখা তাঁর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, বিশেষত বাংলা ব্যালাড ও নাটকের উৎসমূল সম্বন্ধে তাঁর অনুসন্ধিৎসা বিস্ময়কর। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বাংলাদেশেও অধ্যাপক ও পণ্ডিতেরা (যথা—আহমদ শরীফ, আনিসুজ্জামান, আজাহার ইসলাম ইত্যাদি) নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস চর্চা করছেন। আমার মনে হয়, দুই বাংলার বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকেরা একযোগে অনুপুংখভাবে সন্ধান চালিয়ে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা ও রচনা শুরু করলে বাংলা সাহিত্যের একটি পরিপূর্ণ ইতিবৃত্ত রচিত হতে পারে। কারণ বাংলা সাহিত্য উভয় বাংলার এজমালি সম্পত্তি। তারই মধ্যে নিহিত আছে দুই বাংলার কুলপরিচয়।বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস চর্চা যেমন উদার শিক্ষার পরিচায়ক তেমনি উচ্চ-শিক্ষার পাঠক্রমে এর অন্তর্ভুক্তি বিশেষভাবে প্রয়োজন। মধ্যযুগের বহু গ্রন্থ এখনও পুঁথি-পাণ্ডুলিপির মধ্যে নির্বাসন যাপন করছে, তার অতি অল্পই মুদ্রণসৌভাগ্য লাভ করেছে, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকাভুক্ত না হলে তার প্রায় কোনোখানিরই দ্বিতীয় মুদ্রণ হয় না। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও সমাজের সঙ্গে আধুনিক কালের দুস্তর পার্থক্য ঘটে যাওয়ার জন্য একালের পাঠক তার প্রতি বিশেষ কৌতূহল বোধ করে না, তাই মধ্যযুগের সাহিত্য সম্পর্কে আজকের জ্ঞান অত্যন্ত ভাসা-ভাসা। উনিশ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশক থেকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিবর্তন হয়েছে, কিন্তু কয়েকজন ক্লাসিক কবি-সাহিত্যিকের কথা বাদ দিলে সেকালের অনেক লেখকই নিষ্প্রভ হয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁদের কিছু পরিচয় না জানলে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা বোঝা যাবে না। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়, পনেরো খণ্ডে প্রকাশিত The Cambridge History of English Literature এবং বারো খণ্ডে প্রকাশিত Oxford History of English Literature বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার মধ্য দিয়ে গ্রেট ব্রিটেনের সমগ্র সারস্বত চেতনা স্পন্দিত হয়েছে। সেই ধারা অবলম্বন করেছেন আধুনিক-শিক্ষিত বাঙালি লেখকেরাও। বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ইতিহাস পড়া না থাকলে এ-সাহিত্যের কুলপরিচয় ও বিবর্তনের প্রকৃত স্বরূপ বোঝা যাবে না। তাই পাঠার্থীর পক্ষে এ ইতিহাস গভীরভাবে আলোচনার যোগ্য। অনেক পুঁথি নষ্ট হয়ে গেছে, বিশাল পুঁথিভাণ্ডারের স্বল্পতম অংশ ছাপা হয়েছে। ছাপার যুগের সব গ্রন্থও পাওয়া যায় না। সে-সমস্ত গ্রন্থ এখন দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের তালিকায় অস্তিত্ব রক্ষা করছে, ক্রমে তাও মহাকালের গ্রাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। পরবর্তী প্রজন্ম তার সন্ধান পাবে না, ইতিহাসে তার অশ্মীভূত কঙ্কাল রক্ষা পাবে। দীনেশচন্দ্রের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়ে (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড) মধ্যযুগের সাহিত্যের কিছু নিদর্শন রক্ষিত হয়েছে। কিন্তু কালক্রমে তাও আর পাওয়া যাবে না, এখনই তা প্রত্ননিদর্শন তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফ্রাঙ্ক কারমোড ও জন হলাণ্ডার সম্পাদিত The Oxford Anthology of English Literature-এর মতো যদি উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের বিস্মৃতপ্রায় গ্রন্থ ও গ্রন্থকারের শ্রেষ্ঠ রচনার নমুনার সঙ্কলন প্রকাশ করা যেত, তা হলে হয়তো গত শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের অনেকটাই রক্ষা করা যেত। কিন্তু তার জন্য যে বিপুল অর্থ ব্যয় হবে তার দায়-দায়িত্ব কে নেবে? গৌরীসেনের টাকা’ তো অপরিমিত নয়। একালে অনেক মহৎ কাজই বানচাল হতে বসেছে, কারণ ‘অর্থচিন্তা চমৎকারা। এ-সব বৃহৎ সারস্বত যজ্ঞ একালে তো অলীক স্বপ্ন। অবশ্য আধুনিক যান্ত্রিক মুদ্রণের সাহায্যে এর কিছু কিছু রক্ষা পেতে পারে। কিন্তু তাও বহু ব্যয়সাপেক্ষ। তাই মূল্যবান পুঁথিসাহিত্য ও মুদ্রণযুগের সাহিত্যের কোনো কোনো অংশ বিলুপ্তির পূর্বে সাহিত্যের ইতিহাসে তা ধরে রাখা প্রয়োজন। শুধু এ্যাকাডেমিক বা সৌখিন প্রয়োজনেই নয়, বাঙালিচেতনার স্বরূপ নির্ধারণের জন্যই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস জানা প্রয়োজন। এত কথা বলার কারণ, একালে যাঁরা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাঁরা মনে করেন, সাহিত্যের ইতিহাসের টুকরো টুকরো করে কিছু তথ্য জানলেই হবে, এত ‘কাঠ-খড় পুড়িয়ে’ সাহিত্যের ইতিহাস পড়া পণ্ডশ্রম মাত্র।